খোকন বিকাশ ত্রিপুরা জ্যাক, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি :
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় হিজাব পড়ে পরীক্ষা দিতে আসায় এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের অভিযোগ উঠেছে মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও পরীক্ষার কেন্দ্র সচিব কামাল হোসেন মজুমদারের বিরুদ্ধে।
গত শুক্রবার বিকালে মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্ৰে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) এর সমাজতত্ত্ব পরীক্ষার দিন এই ঘটনা ঘটে। এ অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী উম্মে আনজুমানয়ারা। এ ঘটনায় আজ রবিবার দুপুরে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ স্বীকারোক্তি দিয়েছে এবং ক্ষমাও চেয়েছে।
জানা যায়,এর পূর্বেও একাধিকবার বোরকা ও স্কাপ পড়ে আসার কারণে শিক্ষার্থী হয়রানি ও পরীক্ষা দিতে না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ কামাল হোসেন মজুমদারের বিরুদ্ধে। চলমান বাউবি ২০২১ সেশনের ৩য় ও ৪র্থ সেমিস্টার পরীক্ষার ৩য় দিনে।
শুক্রবার ১৩ডিসেম্বর বেলা ২টার দিকে পরীক্ষা শুরুর ৩৫ মিনিট পর হল পর্যক্ষেক ও অত্র কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক আবুল হোসেন হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর নিতে গিয়ে পরীক্ষার্থীর প্রক্সি পরীক্ষার্থী কিনা শনাক্ত করতে নেকাব খোলার জন্য বলেন। এসময় সবার সামনে নেকাব
খুলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে একজন নারী শিক্ষক বা নারী শিক্ষার্থীর সামনে নেকাব/হিজাব খোলার ইচ্ছে পোষণ করে শিক্ষককে অনুরোধ করেন। এতে হল পর্যবেক্ষক আবুল হোসন ক্ষিপ্ত হয়ে অধ্যক্ষ কে জানালে অসদাচরণের অভিযোগে পরীক্ষার্থীকে তাৎক্ষনিক বহিষ্কার করা হয়।
পরীক্ষা হলে অসদুপায় অবলম্বন,খারাপ ব্যবহারও করেনি জানিয়ে ভুক্তভোগী উম্মে আনজুমানয়ারা বলেন, পরীক্ষা সময় হলের অন্য শিক্ষার্থীরা আমার পরিচয় নিশ্চিত করে। তারপরও অধ্যক্ষ এসে আমাকে নেকাব খোলার জন্য বলে। আমি রাজি না হওয়ায় আমার
পরীক্ষার খাতা নিয়ে নেয় এবং বহিষ্কার করার হুমকি দেন। পুলিশ ডেকে আমাকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়। পরে আমি পুলিশের হেল্পলাইন ৯৯৯ এ ফোন করি। এরপর মাটিরাঙ্গা থানা থেকে পুলিশ আসে। এরপর পুলিশ ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে আমার পরীক্ষা কেন্দ্রে যায়। তখনো ১ ঘণ্টার বেশি পরীক্ষার সময় ছিল। এ
সময় অধ্যক্ষ পুলিশ নিয়ে তার কক্ষে চলে যায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫-২০ মিনিট আগে অধ্যক্ষ তার রুম থেকে বের হয়ে মহিলা পুলিশ দিয়ে আমার পরিচয় নিশ্চিত হয়। ততক্ষণে আমার পরীক্ষার সময় শেষ। এমন আচরণে তার সাথে অন্যায় করা হয়েছে উল্লেখ করে এর প্রতিকার এবং সুস্থ্য বিচার চান ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী ।
মাটিরাঙ্গা সদর থানা অফিসার ইনচার্জ তৌফিকুল ইসলাম জানান,বিকাল সাড়ে তিনটায় ৯৯৯ এ কল পেয়ে তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। পুলিশ গিয়ে
পরীক্ষার্থীকে(আনজুমানাআরা)’কে কলেজের গেটের বাহিরে দেখতে পেয়ে কারণ জানতে চাইলে পরীক্ষা হলের বিধি লঙ্গনের (পরীক্ষা পর্যবেক্ষকের সাথে অসদাচরণ ও বিভিন্ন লোকের সাথে মোবাইলে কল করা) দায়ে শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান অধ্যক্ষ।
অপর দিকে বহিষ্কার করার কথা অস্বীকার করে মাটিরাঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ্য কামাল হোসেন মজুমদার বলেন, তিনি বোরকা,হিজাব/নিকাব বিরোধী নয়। নিয়মানুযায়ী পরীক্ষার্থী শনাক্ত করার জন্য হিজাব খোলার জন্য বলা হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালীন পর্যবেক্ষকের সাথে অসদাচরণ, বিভিন্ন লোকের সাথে ফোনে কথা বলে ও ৯৯৯ মোবাইলে কল করে পরীক্ষার শৃঙ্খলা বঙ্গের কারণে শুধু মাত্র সমাজ তত্ব-২ বিষয়টি পরীক্ষা নেয়া হয়নি। অবশিষ্ট্য পরীক্ষা যথা সময়ে দিতে পারবে বলে জানান তিনি।
অপর দিকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কামাল মজুমদার আরো জানান, আমি পুলিশকে মহিলা পুলিশ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি, কিন্তু সেভাবে রেসপন্স পাইনি। পরে ওই শিক্ষার্থী ৯৯৯ ফোন করায় মহিলা পুলিশ আসে। শেষ মুহূর্তে মহিলা পুলিশ এসে ওই শিক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত করে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ কামাল হোসেন মজুমদারের ক্ষমা প্রার্থনার ভিডিও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী উম্মে আঞ্জুমানয়ারা নিজের ফেসবুক আইডিতে লাইভ এ প্রচার করেন। এ সময় হলরুমে দায়িত্বে থাকা আরেক শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক আবুল হোসেনও নিজের দোষ স্বীকার করে
সবার কাছে আন্তরিকভাবে দু:খ প্রকাশ করেন এবং ক্ষমা চান, পরবর্তীতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী যে বিষয়টি পরীক্ষা দিতে
পারেনি,সেদিন যদি পরীক্ষা দিতে পারতেন,সে বিষয়টি পাশ করবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। এছাড়াও পুনরায় পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ তৈরির করে দেয়ার দাবি জানান। তিনি বলে এ বিষয়ে আর কোন ক্ষোভ নেই বলে জানান। তিনি তবে তিনি অভিযুক্ত তিন শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবি জানান। পরিশেষে এ সংক্রান্ত বিষয়ে কেউ যেন
কোন ধরনের উস্কানিমূলক পোস্ট বা মিছিল-মিটিং না করে সে বিষয়ে সকলের প্রতি আহবান জানান।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী উম্মে আঞ্জুমানয়ারা আরও বলেন, যেহেতু উনারা আমার শিক্ষক এবং ক্ষমা চেয়েছেন সেজন্য সবাইকে অনুরোধ করব বিষয়টি নিয়ে আর কোন ঝামেলা করার আহ্বান
জানান ৷
এ সময় মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনজুর আলম,মাটিরাঙ্গা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তৌফিকুল ইসলাম তৌফিক,ঘটনার শিকার শিক্ষার্থী উম্মে আঞ্জুমানয়ারা,প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা,রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, আলেম সমাজের প্রতিনিধি, পার্বত্য নারী সংহতির আহ্বায়ক শাহেনা আক্তারসহ আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে আজ রবিবার সকালে হিজাব খুলে মুখ না দেখানোয় পরীক্ষা হল থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ক্বওমী মাদরাসা ও ওলামা ঐক্য পরিষদ। খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের দ্বারা পরীক্ষার্থী উম্মে আঞ্জুমানয়ারা-কে হেনস্তা ও পর্দার বিধানকে অবমাননার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও কলেজ অভিমুখে প্রতিবাদী মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ মিছিলটি মাটিরাঙ্গা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে থেকে শুরু হয়ে মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের সামনে গিয়ে শেষ হয়৷ এ সময় ভবিষ্যতে কেউ যেন এমন ঘটনার পূনরাবৃত্তি না হয়,যেন সাহস না পায় সেজন্য কলেজের অভিযুক্ত অধ্যক্ষ ও অপর দুইজন শিক্ষককে বহিষ্কারসহ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানানো হয়।
এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন,মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। একই সাথে তাকে বদলি করানো জন্য সুপারিশও করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের নিকট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর স্বারকলিপি প্রদান করেছে। আমরা শিক্ষামন্ত্রণালয় বরাবর পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে তাকে বদলি করার জন্য আমি শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে কথা বলেছি। অভিযোগের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিবে শিক্ষামন্ত্রণালয়
প্রসঙ্গত :শুক্রবার বিকেলে মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রী কলেজ কেন্দ্রে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) সমাজতত্ত্ব পরীক্ষার দিন নেকাব/বোরকা না খোলায় পরীক্ষা দিতে পারে নাই বলে অভিযোগ করেছে শিক্ষার্থী উম্মে আঞ্জমানয়ারা।
বিষয়টি নিয়ে শনিবার ১৪ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় ঘটনার শিকার শিক্ষার্থী। বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পরে। এই ঘটনায় অনেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়৷ স্ট্যাটাসটি ইতিমধ্যে শেয়ার হয়েছে প্রায় ২০হাজার,রিয়েক্ট পড়েছে প্রায় ৩২হাজার মন্তব্য করেছেন প্রায় ১০ হাজার।